লায়েকুজ্জামান, সিনিয়র সাংবাদিক, কালেরকণ্ঠ:সাংবাদিকদের একটি সংগঠনে নির্বাচন করতে গিয়ে বুঝেছি, মতিউর রহমান চৌধুরী কত বড় কারিগর। পত্রিকা অফিসগুলোতে গেলে আওয়াজ পাই, ‘ভাই আমি মানবজমিন-এ কাজ করেছি।’ ১৬ বছর ছিলাম মানবজমিন-এ, এখনো আছি তবে দেহটা নেই শুধু। সে নানা স্মৃতি, মধুময় দিন আবার বেদনাও ছিল। ছিলাম রাজনৈতিক কর্মী। সাংবাদিকতার ইচ্ছাও ছিল না। বাংলাবাজার পত্রিকায় লেখা আমার একটি চিঠির সূত্র ধরে মতি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়, তারপর হয়ে গেলাম সাংবাদিক। থাকতাম মফস্বল শহর ফরিদপুরে। মতি ভাই বললেন, সমস্যা কি? ফরিদপুরেই থাকুন। আমার জন্য একটি পদ সৃষ্টি করলেন। ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি।
ফরিদপুর থেকে বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে হবে।
বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। সেখানে তখন চরমপন্থিদের রাজত্ব। ফরিদপুরে বসবাস করে ঢাকা অফিসের বেতন পেতাম। ওয়েজবোর্ডও দেয়া হয়েছিল আমাকে।
মফস্বলে বসে ওয়েজবোর্ডে বেতন সম্ভবত আমি একাই পেয়েছি তখন। সেটা মতিউর রহমান চৌধুরীর কারণে। তিনি অফিস মিটিং এ বলতেন, ভালো সাংবাদিক, ভালো কাজের মানুষ শুধু ঢাকাতেই থাকেন না, জেলা-উপজেলাতেও আছেন।’
মফস্বল সাংবাদিকদের নিউজ লিড হয়, এটা মানবজমিনই প্রথম দেখিয়েছে। জেলা শহর থেকে অনেক সাংবাদিককে ঢাকায় এনেছেন মতি ভাই। তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। মানবজমিন-এর আরেকটি বড় অবদান নারী সাংবাদিকদের এগিয়ে নেওয়া। সফলভাবে কাজটি করেছেন মতিউর রহমান চৌধুরী-মাহবুবা ভাবী।
দু’বার চাকরি খোয়াতে হয়েছিল, নিউজের কারণে। একবার তো প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং খেপেছিলেন। মতি ভাই সবকিছু সামাল দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। মামলার খড়গে পড়তে হয়েছে বারবার। মতি ভাই কখনো বিরক্ত হননি, বরং সাহস যুগিয়েছেন, বলেছেন সাংবাদিকতা করলে মামলার ঝুঁকি থাকবেই। যশোরে এক আওয়ামী লীগ এমপি’র ছেলের দায়ের করা মামলায় মতিউর রহমান চৌধুরী, মাহবুবা ভাবী ও আমি একসঙ্গে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। আজও মনে আছে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় মতি ভাই আমার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ভয় পাবেন না, আমি তো আছি। মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো সাংবাদিক-বান্ধব সম্পাদক দ্বিতীয়জন দেশে আছেন বলে আমি মনে করতে পারছি না।
তখন ফকরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন, ইয়াজউদ্দিনদের সরকার। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। মাইনাস টু ফর্মুলা তখন আলোচিত ঘটনা। মতি ভাই তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে রাজনীতি করতে পারবে না, উনারা করবেন- এটা মানা যায় না। বললেন, আমি ঝুঁকি নিতে রাজি, আপনি শেখ হাসিনার জন্য ঝুঁকি নেবেন? বললাম জি আমি রাজি। পকেট থেকে টাকা বের করে আমাকে টুঙ্গিপাড়া পাঠালেন, সরজমিন প্রতিবেদন করতে। বঙ্গবন্ধুর মাজার থেকে মঈনউদ্দিনের লোকেরা আমার ঘাড় ধরে উঁচু করে গাড়িতে তুলে পাটগাতির দিকে নির্জন সড়কে নামিয়ে বললো, সোজা ঢাকায় চলে যাবি। তারপরও এসে প্রতিবেদন করলাম, মতি ভাই শিরোনাম ঠিক করে দিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারেননি, শেখ হাসিনা কিন্তু দেখছেন।’ পরের দিন আওয়ামী লীগের এক জাঁদরেল নেতা ডেকে নিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বললেন, এই কি দেখছে, তোর শেখ হাসিনা? নেতার মুখের ওপর বলেছিলাম, শেখ হাসিনার দিন এমন সারা জীবন থাকবে না, একদিন টের পাবেন শেখ হাসিনা কি দেখছেন?
২০০৮ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ার পর ওই নেতাকে বলেছিলাম, কি ভাই টের পেলেন, শেখ হাসিনা আপনাদের বেঈমানি জেলে বসে দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছিলেন, দেখতে পারেননি, কারা বেঈমান ছিল, শেখ হাসিনা কারাগারে বসে দেখেছিলেন, কারা তাঁকে নির্বাসনে পাঠাতে চেয়েছিল।