হাসন আলী, বিশেষ প্রতিনিধি: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত গরু মারা যাচ্ছে এতে করে আতঙ্কিত গবাদিপশুপালনকারি গৃহস্থ ও খামারিরা। এলএসডিতে আক্রান্ত হয়ে গরু মারা গেলেও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত) ডা. রিপা রানীর নিকট এই বিষয়ে কোন তথ্য নেই। ভুক্তভোগীরা হসপিটালে সঠিক চিকিৎসা ও ওষুধ পাচ্ছেন না বলে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন।
গোদাগাড়ী পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের মহিশালবাড়ী মেল পাড়ার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে কালুর ৯০ হাজার টাকার গরু লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগে আক্রান্ত হয়েছিল ডা. রিপা রাণীর নিকট চিকিৎসা করে সাড়ে ৩ হাজার টাকার ইনজেকশন ও ওষুধ সেবন করান পরদিন তার গরুটি মারা যায়। মহিশালবাড়ী ফকিরপাড়ার লুথুর ছেলে আবু ৮০ হাজার টাকা মূল্যের আক্রান্ত গরু নিয়ে বুধবার সাড়ে ১১ টার সময় গোদাগাড়ী পশু হাসপাতালে যান। ডা. রিপা রাণীর নিকট দেখা করেন কিন্তু তিনি গরুর কোন চিকিৎসা না দিয়ে বাইরে কাজ আছে বলে বেরিয়ে যান। চিকিৎসা না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
একই অভিযোগ শিবসাগরের আব্দুল লতিফের তার ৭০ হাজার টাকার গরুকে হোমিও চিকিৎসা করান । গত বুধবার এলএসডি আক্রান্ত ৩ টি গরুর ও অন্য রোগে আক্রান্ত ২ গরুর চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর শিয়ালা গ্রামের হাজেরা বেগম প্রতিবেদককে বলেন, তাকে যে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়েছেন ৪/৫ হাজার টাকার দামী ওষুধ ও ইনজেকশন। ব্যবস্থা পত্র পেয়ে তার চোখেমুখে কালো মেঘ নেমে আসে। অফিস থেকে সুধুই মিকচার ছাড়া কিছুই দেয়া হয় নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই রোগটি পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
গোদাগাড়ী পৌরসভার মহিশালবাড়ী, হাটপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, শিবসাগর, মাদারপুর, লালবাগ, বাইপাস, কুঠিপাড়া, সিএন্ডবি, গঠের মাঠ, উপজেলার বসন্তপুর, চাঁপাল, রাজবাড়ি, হাসাবপুর, আই হাই রাহী, হেলিপ্যাড, কাঁকনহাট, মোল্লাপাড়া, নাজিরপুর, প্রেমতলী, পিরিজপুর, হাতিবান্ধা, চম্পকনগর, রিশিকুল, পাকড়ী, হুজরাপুরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই রোগ ব্যাপকহারে দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় খামারিরা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। রোগটির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক ও গৃহস্থরা।
উপজেলার অনেক খামারি ও কৃষক ‘লাম্পি স্কিন’ রোগে আক্রান্ত গরুগুলোকে খুবই কম দামে স্থানীয় কসাইদের নিকট বিক্রি করছেন । তারা রাতের আধারে জবাই করে মাংস বাজারে দেদারসে বিক্রি করছে।এই রোগাক্রান্ত গবাদিপশুর মাংস খেয়ে মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, মারাত্মক এ রোগ মশা, মাছি, নিভেল ও সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহারের মাধ্যমে আক্রান্ত পশু থেকে সুস্থ পশুর শরীরে ছড়াচ্ছে। রোগটির সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক না থাকায় দিশেহারা গৃহস্থ ও খামারিরা। এই লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) ভয়ংকর একটি রোগ। এই রোগ গোদাগাড়ী উপজলায় মহামারী রুপ ধারণ করেছে। রোগটি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ায় অনেক খামারি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দেখার যেন কেউ নেই।
এ রোগে আক্রান্ত হলে গবাদিপশুর প্রথমে গরুর শরীর গরম হয়ে জ্বর উঠে। তারপর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট গুটি উঠতে শুরু করে। কোন কোন গরুতে অনেকগুলি বড় বড় গুটি হচ্ছে, গরুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে সারা শরীরেই ছড়িয়ে পড়ে। শরীর ফুলে যাচ্ছে এবং গরুর খাবারে অনীহা দেখা দিচ্ছে, গরু দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে জানান খামারিরা।
আক্রান্ত গরু অনেক সময় মারা যাচ্ছে। গৃহস্থ ও খামারিদের অভিযোগ, রোগটি বর্তমানে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা প্রানিসম্পদ অফিসে এসে তারা চিকিৎসা না পেয়ে উপায়হীনভাবে গ্রামের কিছু পশু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এতে গরু সুস্থ না হয়ে বরং বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাছাড়া প্রানিসম্পদ অফিসে এককই সিরিঞ্জ দিয়ে একাধিক গরুকে ইনজেকশন পুশ করার অভিযোগও করছেন।
গোদাগাড়ী পৌর এলাকার খামারি মর্জিনা খাতুন বলেন, আমার পোষা ৫ মাস বয়সী একটি গরু এই রোগে হঠাৎ করেই আক্রান্ত হয়। শরীরে প্রচন্ড জ্বর থাকায় ঠিকমত খাওয়া ও চলাফেরা করতে পারছে না। পুরো শরীর গোটা হয়ে যাওয়ায় গরু ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে দূর্বল হয়ে পড়েছে। গরু নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি। উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে চিকিৎসা সেবা চলছে সুস্থ হওয়ার কোন লক্ষন দেখছেন না। সব ওষুধ দোকান থেকে কিনতে হয়েছে বলে তিনি জানান। স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন তার তার গরুর জন্য ক্রিমি ও জ্বরের জন্য ডা. রিপা রাণী নিকট গত মঙ্গলবার অফিসে যান। তিনি ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।
জুলাই মাসে যদি এসব ওষুধ শেষ হয়ে যায় এটা খুবই দুঃখজনক বলে তিনি জানান।
হুজরাপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাক মাষ্টার জানান, আমার ভাই শাহজামালের একটি গরু লাম্পি স্কিন (এলএসডি) রোগে আক্রান্ত হয়েছে কোন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেনা। এলাকায় ব্যাপকহারে গবাদিপশু আক্রান্ত হচ্ছে। হোমিও চিকিৎসা একমাত্র ভরসা বলে তিনি জানান। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ( ভারপ্রাপ্ত) একটি লিফলেট ধরিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। ভেটেনারী সার্জন ডা. রিপা রাণীর নিজে ওষুধের রেজিষ্টার লিখার কথা থাকলেও তিনি না লিখে তিন মাসের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ২ জন বাইরের ব্যক্তিকে দিয়ে এখাতাটি লিখা হচ্ছে। অনাভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে হাসপাতালে বসিয়ে রেখে ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে, তারা এককই সিরিঞ্জ তারা একাধিক আক্রান্ত গরুর গায়ে ইনজেকশন পুশ করছেন। এতে লাভের চেয়ে বেশী ক্ষতি হচ্ছে।
মেলপাড়ার সাহাবউদ্দিন জানান, পশু হাসপাতালে এসেও ঘুরে যাচ্ছি ডাক্তার পাচ্ছি না । এখানে নাকি কোনো ডাক্তার নেই। এ অবস্থায় গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছি।
গোদাগাড়ী উপজেলার পল্লী চিকিৎসক রবিউল ইসলাম জানান, গত ৩ সপ্তাহ যাবত গরুর লাম্পি স্কিন রোগের সংক্রমণ ব্যপকহারে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই কয়েকটি করে এমন রোগে আক্রান্ত গরু দেখছি। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ দেখে আক্রান্ত পশুকে পেনিসিলিন, এন্টি হিস্টামিন এবং জ্বর হলে প্যারাসিটামল প্রয়োগ করলে এই স্কিন রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে।